নাজমা খাতুনের “কুসুম কলি”

‘দুই ঘণ্টায় জ্বলেপুড়ে শেষ হলো আমার তিলতিল করে গড়ে তোলা কুসুমকলির কারখানা। আগুনের তীব্রতা এত বেশি যে, একটি সুতাও আমরা বের করতে পারলাম না। কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ মনে হলো, “কী লাভ কান্নার? আমাকে ফের ঘুরে দাঁড়াতে হবে।”

কথাগুলো বলছিলেন নাজমা খাতুন। ২০১২ সালের ২৫ জুন গাজীপুরে তাঁর ছোট্ট জুতার কারখানা পুড়ে শেষ হয়ে যায়। নাজমার গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু তা হয়নি; বরং এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁর উত্থানের কাহিনি।

নাজমা খাতুন বর্ণনা করেন কীভাবে দু’বার শূন্য থেকে সবকিছু শুরু করতে হয়েছিল তাঁকে।

আগুন লেগে জুতার কারখানা পুড়ে যাওয়ার দিন রাতেই কাগজপত্র নিয়ে বসেছিলেন তিনি। দুই দিন আগে নামীদামি জুতার একটি কোম্পানিতে জুতা সরবরাহের বিল পেয়েছিলেন ১৭ লাখ ৭১ হাজার টাকার। ব্যাংকে সেটিই জমা হয়েছে। আর আছে দুই খদ্দেরের দুটি কার্যাদেশ। কাঁচামাল কী কী লাগবে দুই কার্যাদেশের জন্য, রাতেই হিসাবনিকাশ করে ফেললেন। ১৬ জন কর্মী রেখে বাকি কর্মীদের বেতন চুকিয়ে দিয়ে অন্য কোথাও কাজ নিতে পরামর্শ দিলেন। তাঁর সাহস আর পরিকল্পনা দেখে সাপ্লায়াররা তাঁকে বাকিতে কাঁচামাল দিতে রাজি হয়েছিল। লতিফপুরে এক কারখানার মালিক তাঁর কারখানার কিছু অংশ নাজমাকে ছেড়ে দিলেন। আরেক কারখানার মালিক নাজমাকে ধার দিলেন তিনটি মেশিন। ধারের মেশিন আর ১৬ জন কর্মী দিয়ে শুরু হলো নাজমার জীবনের দ্বিতীয় লড়াই।

দেড় বছর পরের কথা। সকালে রুটি বানাতে বানাতে নাজমার চোখ গেল দৈনিক প্রথম আলো’র বাণিজ্য পাতায়। দেখলেন মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে পরদিন থেকে শুরু হবে তিন দিনের একটি ব্যবসা সম্মেলন। এর মাত্র কয়েক দিন আগে ১০ হাজার টাকা দিয়ে পাসপোর্ট আর মালয়েশিয়ার ভিসা জোগাড় হয়েছে। সকাল ১০টার মধ্যে একজনের কাছ থেকে এক লাখ টাকা ধার করে টিকিট কেটে বাসায় ফিরলেন।

সকালে মালয়েশিয়া এয়ারপোর্টে নেমে প্রথমে একটু ভয় পেয়েছিলেন। এই প্রথম তাঁর দেশের বাইরে আসা, তা–ও একা। এয়ারপোর্ট থেকে এক আত্মীয়কে ফোনে জানালেন, তাঁকে যেন একটা হোটেলে পৌঁছে দেওয়া হয়। হোটেলে গিয়ে ব্যাগ-ব্যাগেজ রেখে হাজির হলেন সম্মেলনকেন্দ্রে। পরের তিন দিন সম্মেলনকেন্দ্রে আর ১১ দিন কুয়ালালামপুরে মার্কেটে মার্কেটে ঘুরলেন নাজমা খাতুন।

এক মাস পরে আবার গেলেন কুয়ালালামপুরে। ‘১০০ ভাগ বিদেশি বিনিয়োগ’ কোটায় নিবন্ধন করলেন ‘ভিনকা’ নামের নিজের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠান। খুঁজে বের করলেন শোরুমের জায়গা। চালু করলেন নিজের জুতার দোকান। মালয়েশিয়ায়।

নাজমা খাতুনের গাজীপুরের কারখানার জুতা দেশের বাইরে বিক্রি হচ্ছে মালয়েশিয়ায়।

অথচ ১৯৯১ সালে অল্প বয়সে নাজমার বিয়ে হয় পাশের বাড়ির মিজানুর রহমানের সঙ্গে। আড়াই বছরের মেয়েকে কোলে নিয়ে পাস করেছেন এসএসসি, মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে থেকেছেন হোস্টেলে, পাস করে হয়েছেন প্যারামেডিকস। কিন্তু ছোটবেলা থেকে ইচ্ছে ‘বড় কিছু করার’।

প্যারামেডিকসের চাকরি করার পাশাপাশি যুব উন্নয়নের নানা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। কিন্তু কী করবেন মনস্থির করতে পারেননি। ২০০৫ সালে এক জুতার কারিগরের পরামর্শে বাসার সেলাই মেশিনটি পরিবর্তন করে সূচনা করেন কুসুমকলি’র। দেড় বছর শেষে বুঝতে পারেন, বাজারে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা দেনা আর জুতা বানানোর জ্ঞান ছাড়া আর কিছুই অর্জিত হয়নি। ব্র্যাক ব্যাংক থেকে ৪ লাখ টাকার ঋণ নিলেন আর সেখান থেকে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা পুরোনো ঋণ শোধ করলেন। ৪০ হাজার টাকা হাতে নিয়ে নামলেন মাসে কমপক্ষে ৮১ হাজার টাকা উপার্জন নিশ্চিত সংগ্রামে। এবার আর ভুল করলেন না। নিজেই নামলেন উৎপাদনে, কারখানার কর্মীদের সঙ্গে নিজেই হয়ে গেলেন কর্মী। প্রতিদিন ৪৮ জোড়া জুতা তৈরি করে সেটি সন্ধ্যাবেলায় তুলে দিতেন স্বামী মিজানুর রহমানের হাতে। মিজানুর রহমান সেটি বিক্রি করে পরদিনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল কিনে মধ্যরাতে বাড়ি ফিরতেন!

“আমার মন্ত্র ছিল—সততা, সময়মতো ডেলিভারি দেওয়া এবং সাশ্রয়ী মূল্যে স্যান্ডেল বানানো।”

সেই স্যান্ডেল বানিয়েই কুসুম, কলি আর নয়না নামের তিন মেয়ের মা নাজমা খাতুন গড়ে তুলেছেন দেশে আর মালয়েশিয়ায় তাঁর স্যান্ডেলের সাম্রাজ্য। লতিফপুরে নিজের ১০ শতাংশ জমির কারখানায় কাজ করেন ১৩০ জন কর্মী। পাশেই তৈরি হয়েছে নতুন শেড, আসছে নতুন মেশিন। যেখানে সাকুল্যে উৎপাদনক্ষমতা দাঁড়াবে দৈনিক আড়াই হাজার জোড়া। নিজেই বানাবেন জুতার সোল। সেখানে, বেক্সিমকো শিল্পপার্কের পাশে জমি কিনেছেন। আগামী বছরেই তৈরি করবেন নিজের ‘কমপ্লায়েন্স কারখানা’, যাতে বের হতে পারেন বিশ্বজয়ে!

চাকরি খুঁজব না চাকরি দেব -এর পক্ষ থেকে নাজমা খাতুনকে ইউসুফ চৌধুরী সম্মাননা স্মরকে সম্মানিত করা হয়।

Leave a Reply