প্রতিষ্ঠিত ও সম্মানজনক ব্যবসার মধ্যে ফার্মেসি ব্যবসা অন্যতম। এখানে পুঁজি বিনিয়োগ করে সহজেই লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ফার্মেসি ব্যবসা করে সফল হওয়ার স্বপ্ন অনেকেই দেখেন। কিন্তু ইচ্ছা করলেই যে কেউ ফার্মেসি ব্যবসা শুরু করতে পারবে না।
প্রথমেই ফার্মেসি খুলে বসার আগে তার ফরমালিটি এবং অবশ্যকরণীয় ব্যাপারগুলো বলা যাক-
ব্যবসার অন্যান্য আনুসাঙ্গিক প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের সাথে আরো অতিরিক্ত করতে হবে ফার্মাসিস্টের ট্রেনিং এবং ড্রাগ লাইসেন্স। ওষুধ তিনিই বিক্রি করতে পারবে যার ফার্মাসিস্ট ট্রেনিং আছে এবং যিনি ড্রাগ লাইসেন্স পেয়েছেন। ড্রাগ লাইসেন্স ছাড়া ওষুধের ব্যবসা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং আইনগতভাবে এটি একটি দন্ডনীয় অপরাধ।
আর ওষুধ ব্যবসার জন্যে অতি প্রয়োজনীয় এই ড্রাগ লাইসেন্সটি ইস্যু করে বাংলাদেশ সরকারের ‘ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর’।
এবং উক্ত ড্রাগ লাইসেন্সটি অর্জন করতে হলে ‘বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল’ থেকে আপনাকে ছয় মাসের একটি ফার্মাসিষ্ট ট্রেনিং কোর্স সম্পন্ন করতে হবে।
ড্রাগ লাইসেন্সের জন্যে আবেদন করতে যা প্রয়োজনঃ
১। ট্রেড লাইসেন্স
২। টি.আই.এন সনদপত্রের ফটোকপি
৩। পাসপোর্ট সাইজের ছবি
৪। ব্যাংক একাউন্ট এবং ব্যাংক সচ্ছলতার সনদপত্র
৫। দোকান ভাড়ার রসিদ/চুক্তিপত্র (নিজস্ব দোকানের ক্ষেত্রে দলিলের সত্যায়িত ফটোকপি)
৬। ফার্মাসিস্ট ট্রেনিং এর সনদপত্রের ফটোকপি
৭। নাগরিকত্বের সনদপত্র/ভোটার আই.ডি কার্ডের ফটোকপি
৮। ফার্মাসিস্টের অঙ্গীকারপত্র [ফরম নম্বর-৭] (যথাযথ ভাবে পূরণকৃত)
এবার আসা যাক প্লেইসমেন্টের ব্যাপারে আলোচনা। আপনি যদি খুচরা ফার্মেসি খুলতে চান তাইলে সবচেয়ে লাভজনক হল যেকোন মেডিক্যালের আশেপাশে দোকান নিয়ে বসা।তবে এক্ষেত্রে আশেপাশের ব্যবসায়ীদের সাথে পাল্লা দিতে হলে খুব উঁচু মানের ক্যাপিট্যাল লাগবে। শুধুমাত্র মেডিসিনের জন্য আপনার হয়তঃ লাখ পনেরোর মত লাগতে পারে।(যদি সাচ্ছ্যন্দে টিকে থাকতে চান)। আর যদি মেডিক্যালগুলোর আশেপাশে না হয়ে আপনার সুবিধামত স্থানে ফার্মেসি নিয়ে বসতে চান তাহলে আপনার হয়তঃ পুঁজি খুব বেশি লাগবে না। এলাকার মধ্যে দোকান করতে গেলে প্রাথমিক ভাবে ৫-৭ লক্ষ টাকা নিয়ে শুরু করতে পারেন এবং আরো ৩ লক্ষ টাকা রিজার্ভ ফান্ডে রেখে দিবেন। চাহিদা এবং পরিস্থতি অনুয়ায়ী ধীরে ধীরে এই ৩ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করবেন। আর বড় রাস্তার ধারে বা কোনো হাসপাতালের আশেপাশে দোকান করতে চাইলে ১৫-৩০ লক্ষ এমনকি ৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ লাগতে পারে।
ফার্মেসিতো দিলেন কিন্তু ক্রেতার সমাগম কিভাবে ঘটাবেন ? প্রতিটা এলাকায়, রাস্তার মোড়ে মোড়ে এখন ফার্মেসি। সুতরাং আপনি যদি ব্যতিক্রমী সেবা দিতে না পারেন এবং অন্যদের থেকে দ্রুত সেবা দিতে সক্ষম না হন তাহলে আপনি পসরা জমাতে ব্যর্থ হবেন।
আসুন এবার দেখি ভোক্তা সমাগম ঘটাতে আপনি কি ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারেন। শুরু থেকেই ভোক্তাকে আপনার দোকানের উপর নির্ভরশীল করে ফেলুন যেন তিনি আপনাকে বা আপনার দোকান ছাড়া অন্য কিছু না বুঝেন। কিভাবে করবেন তার কিছু পলিসি দেখে নিন –
১। কাস্টোমারকে সালাম দিন এবং হাসিমুখে কুশল জিজ্ঞেস করুন। তারপর প্রেসক্রিপশনটি নিয়ে তাঁর কি কি ঔষুধ লাগবে জেনে নিন। প্রয়োজনীয় ঔষুধগুলো বের করে তার সামনে রাখুন এবং তাঁকে ঔষুধগুলো খাওয়ার নিয়ম ও সময় সম্পর্কে ভালোমত বুঝিয়ে দিন। এরপর ঔষুধগুলো যথাযথ ভাবে প্যাকেট করে তাঁর হাতে তুলে দিন। এবং বলে দিন যে, কোনো সমস্যা হলে তিনি যেনো কষ্ট করে আবার আসেন।
২। বয়স্ক কাস্টোমারদের জন্যে বসার ব্যবস্থা রাখুন। তবে খেয়াল রাখবেন দোকানে যেন আড্ডা না জমে যায় !
৩। আপনি, দোকানে অবস্থান করা অবস্থায় কোনো কাস্টোমারের সাথে রাজনীতি, ধর্ম বা দেশের সমসাময়িক পরিস্থিতি নিয়ে কোনো কথা বলবেন না। কাস্টোমার এ সকল বিষয়ে কথা তুললেও আপনি হাসিমুখে তাকে সমর্থন করে যাবেন মাত্র।
৪। সকালে এবং সন্ধ্যায় এলাকার বয়স্ক এবং একটু অসচ্ছল রোগীদের বিনামূল্যে ব্লাড সুগার, ব্লাড প্রেসার ইত্যাদি পরীক্ষা করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন।
৫। প্রতি মাসে একদিন বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন।
৬। প্রতি ২ মাসে একবার বিনা মূল্যে ২০/২৫ জনের রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করে দিতে পারেন।
৭। এলাকায় ব্যবসা করতে গেলে কিছু কিছু জায়গায় হয়তো বাকিতে বিক্রি করতে হবে। এক্ষেত্রে যিনি বাকিতে ক্রয় করবেন তিনি যদি পরপর তিন বার পাওনা পরিশোধে তার কমিটমেন্ট ঠিক না রাখে তবে তাকে প্রথমে আপনার অপারগতা বুঝিয়ে বলবেন এবং তাতে কাজ না হলে তার কাছে বিক্রি বন্ধ করে দিবেন। মেইন রোডে বা কোনো হাসপাতালের সাথে দোকান হলে অবশ্য বাকি বিক্রির ঝামেলা নাই।
৮। যত মুনাফাই থাকুক না কেন; কোনো অবস্থাতেই মেয়াদবিহীন এবং আজে বাজে কোম্পানির ঔষুধ বিক্রি করবেন না।
৪, ৫ এবং ৬ নং কাজগুলো করতে গেলে আপনার অতিরিক্ত কিছু অর্থ এবং সময় হয়তো ব্যয় হবে কিন্তু এর বিনিময়ে আপনি একটি নিয়মিত কাস্টোমার সার্কেল পাবেন। দ্রুত আপনার ব্যবসার প্রচার, প্রসার এবং সুনামও বাড়বে বলে আমি মনে করি। সর্বোপরি একজন ব্যবসায়ীর হিসেবে সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গায়ও আপনি পাবেন পরিপূর্ণ মানসিক প্রশান্তি!
খুচরো ঔষধের ব্যবসাই করতে হবে এমন কোন কথা নেই। আপনার যদি বিনিয়োগ সক্ষমতা ভাল থাকে তাহলে আপনি বাজার প্রতিযোগীতায় একটু এগিয়ে থাকতে শুরু করতে পারেন পাইকারী ঔষধ সরবারহের ব্যবসা। পাইকারী ব্যবসা করতে হলে আপনাকে যে বিষয়গুলোর প্রতি নজর রাখতে হবে –
১। যারা প্রত্যন্ত অঞ্চল বা মফস্বলে ফার্মেসি খুলে বসেন তারা হয় কোন ডাক্তারের চেম্বার বানিয়ে নেন নতুবা তারা নিজেরাই ছোট-খাট ট্রেইনিং এর মাধ্যমে হাতুড়ে ডাক্তারি শিখে নেন(যদিও আমি এই ব্যাপার সাপোর্ট করিনা।)
২। এইসব খুচরা দোকানদার অধিকাংশ সময়ে তাদের নিজেদের পছন্দমত ঔষধ কিনে থাকেন। ব্যপারটা উদাহরণ দিয়ে বলি।
আমরা প্রায় সবাই জানি নাপা, এইচ, প্যারাপাইরল এইগুলো সব প্যারাসিটামল। এখন কোন ছোটখাট কোম্পানি যদি অল্প দামে তাদের প্যারাসিটামল বাজারে ছাড়ে তাহলে এইসব দোকানদার সেই প্যারাসিটামলগুলো খুঁজে খুঁজে বের করেন। কারণ যেখানে তার দোকান সেখানে তিনি নিজেই ডাক্তার অথবা তার ডাক্তার এমনভাবে প্রেসক্রাইভ করেন যাতে করে সমস্ত ঔষধ ওই দোকানেই পাওয়া যায়। এসব ছোট-খাট কাস্টোমারদের জন্য হলেও আপনাকে অনামী, অল্পদামী কিছু প্রোডাক্ট রাখতে হবে।
৩। একবার কাস্টোমার ধরে ফেললে কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না।
ধরেন আপনার কাস্টোমার যে ঔষধটা এখন দরকার সেটা আপনার নেই। কিন্তু তার অন্যান্য অনেক ঔষধ আপনি তাকে দিতে পারবেন।সেক্ষেত্রে যেসব ঔষধ আপনার নেই সেগুলো আপনি আপনার কর্মচারীকে দিয়ে পাশের দোকান থেকে এনে দিতে পারেন। এ ব্যাপারে সৎ থাকা খুবই জরুরী। কারণ কাস্টোমার বাইরে যাচাই করে দেখলেন পার বক্স ঔষধ আপনি তার কাছ থেকে বেশ ভালরকমই বেশি নিয়েছেন। সেক্ষেত্রে আপনি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবেন।
৪।আরেকটা কথা না বললেই নয়। ঔষধ আপনার নিজের বানানো নয়। তাই আপনি যাচ্ছেতাই দাম নিতে পারবেন না। হ্যাঁ, আপনি হয়ত ঔষধের গায়ে যে দাম আছে ওই দামেই বিক্রি করছেন। কিন্তু আপনার পাশের দোকানে ওই ঔষধ আরো ২টাকা/বক্স কমে বিক্রি করা হচ্ছে। আপনি কিন্তু হেরে গেলেন। আপনি যদি আপনার ক্রয়মূল্যেও বিক্রি করতে না পারেন সেক্ষেত্রে ঔষধটা তখন বিক্রি করবেন না। প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে বুদ্ধি খাটাতে হয়।
৫। পাইকারি ব্যবসায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় কোম্পানি যে দামে ঔষধ বিক্রি করে তার চেয়ে বাজারে অনেক কম দামে ওই ঔষধ পাওয়া যায়। আপনার উচিত তখন কোম্পানির কাছ থেকে না কিনে বাজার থেকে ওই ঔষধ কিনে মজুদ করে রাখা। তাতে দুটা লাভ। আপনার কাস্টোমারকে কম দামে বিক্রি করতে পারবেন। যেহেতু কোম্পানিতে ঔষধটার দাম বেশি, কিছুদিনের মধ্যেই বাজারেও দাম বাড়বে। সেক্ষেত্রে আপনার লাভও বেড়ে যাবে।
ফার্মেসি পরিচালনা বিষয়ে আরো কিছু কথাঃ
আপনার ফার্মেসিটি যদি বড় রাস্তা বা কোনো হাসপাতালের আশেপাশে হয় তাহলে চেষ্টা করুন ২৪ ঘন্টা খোলা রাখার ব্যবস্থা করতে। এলাকার মধ্যে হলে যদি সম্ভব হয় তবে ২৪ ঘন্টা খোলা রাখতে পারেন নয়তো খুব ভোরে খুলবেন বিশেষ করে মানুষ যখন সকালে হাঁটতে বের হয় এবং গভীর রাতে (রাত ০১ টার পরে) বন্ধ করবেন। দুপুরে খাবার সময় দোকান বেশি সময়ের জন্যে বন্ধ রাখবেন না। সম্ভব হলে দোকানেই দুপুরের খাবার কাজটি সেরে নিতে পারেন এবং অন্যান্য সরকারি বেসরকারি ছুটির দিনগুলোতেও আপনাকে আপনার প্রতিষ্ঠান খোলা রাখতে হবে। কেনো না এটি একটি সেবামূলক ব্যবসা এবং অন্য যে কোনো সেবামূলক ব্যবসা হতেও এটি আলাদা এবং এই ব্যবসার সামাজিক দায়বদ্ধতা অনেক অনেক বেশি। এলাকায় ব্যবসা শুরু করলে আপনার দোকানে এমন একজন লোক রাখুন যে কি না ইমারজেন্সি প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন। ইনজেকশন, স্যালাইন ইত্যাদি পুশ করতে এবং ক্ষতস্থান সেলাই ও ব্যান্ডেজ করতে পারেন অথবা আপনি নিজেই এই কাজগুলো শিখে নিন !
- Written by: bdpreneur
- Posted on: June 11, 2018
- Tags: উদ্যোগ, ঔষধ, নতুন ব্যবসা, ফার্মেসি, বিজনেস আইডিয়া, ব্যবসা ব্যবস্থাপনা, স্টার্টআপ