স্টার্টআপ এর ব্যর্থতার অন্যতম ৫টি কারন!

খোদ আমেরিকার মত “উদ্যোক্তা বান্ধব” দেশেই প্রতি ১০টা নতুন প্রতিষ্ঠান বা স্টার্টআপ এর মধ্যে দু’টি স্টার্টআপ মাত্র এক বছরের আগেই গুটিয়ে যায়। সেখানে বাংলাদেশের মত দেশে এই সংখ্যাটা আরও বেশী। কিন্তু কেন? আজকে আমরা সে বিষয়েই আলোচনা করবো।

সারা বিশ্বেই ‘স্টার্টআপ জীবন’কে খুব চাকচিক্যময়, আনন্দের এবং সর্বোপরী খুব টাকা পয়সা আসবে এমন একটি পন্থা হিসাবে দেখানো হয়। যেখানে বাস্তবতা সম্পূর্ণটাই ভিন্ন। প্রথমতে বললাম ১০টিতে দু’টি স্টার্টআপ এক বছর পূর্তি করতে পারে না; সেখানে আরও ৭টি প্রতিষ্ঠান যোগ করতে পারেন, যারা মাত্র ১০ বছরই পার করতে পারে না! অর্থ দাড়ালো, প্রতি ১০টি স্টার্টআপের ৯টিই মাত্র ১০ বছরের মধ্যে হারিয়ে যায়। কি, খুব ঘাবড়ে গেলেন? আসুন না, দেখি কেন এমন ঘটে, চেষ্টা করি আপনার প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে!

১. ইন্ডাস্ট্রি লিডারের সাথে প্রতিযোগীতায় টিকতে না পারাঃ

আপনি যদি এমন একটি ব্যবসা শুরু করেন, যেখানে মার্কেটে একটা বড় প্রতিষ্ঠান আছে, যে তার থেকে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলিকে গুড়িয়ে দিতেই বেশী আগ্রহী, তাহলে আপনি কিন্তু বিপদেই আছেন। কারণ ঐ বড় প্রতিষ্ঠানের সাথে যুদ্ধে জেতাটা এত সহজ হবে না, একটি স্টার্টআপের জন্য। আপনাকে শুরুতেই বড় একটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। আপনি যদি আগামীকাল একটি ‘সৌন্দর্য্য সাবান’ বের করেন, তাহলে আপনাকে Lux, Dove এর মত বড় প্রতিষ্ঠানের সাথে পাল্লা দিতে হবে। আপনি যদি টিস্যু তৈরীর কারখানা করতে চান, আপনাকে অবশ্যই বসুন্ধারার মত প্রতিষ্ঠানের মোকাবেলা করতে হবে।

আর একারণেই ‘প্রতিযোগীতামূলক নিশ নিয়ে কাজ করতে হলে আপনাকে বড় মোকাবেলার কথা মাথাতে রাখতেই হবে। আপনার ব্যবসা শুরু করবার আগেই SOWT এনালাইসিসে এই বিষয়টি আপনাকে রাখতেই হবে। নতুবা, আপনি খুব বেশীদিন টিকছেন না বলে ধরে নেওয়া যায়।

২. অতিরিক্ত খরচঃ

“টাকা পয়সা খরচ করতে কোন জ্ঞানই লাগে না, এবং দুঃখের কথা এই যে, অনেক স্টার্টআপই প্রথমেই যথেষ্ট ফান্ড পেলেও দ্রুত সে টাকা পুড়তে থাকে এবং তারা আশা করে যে তাদের টাকা শূন্য হবার আগেই তারা আরও বড় অংকের টাকা ফান্ড হিসাবে পাবে। এবং যখন তারা আর টাকা পায় না, তারা শেষ হয়ে যায়।” এমনটাই ব্যাখ্যা করেন পেটকেয়াররেক্স এর প্রতিষ্ঠাতা ব্রসম্যান।

আপনাকে আপনার খরচের উপরে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। ব্যবসা বেশীদিন টেকাতে প্রতিটি পয়সার হিসাব আপনাকে করতে হবে। যদি খরচ আপনার আয়ত্বের বাইরে চলে যায়, আপনার ব্যবসা ভয়ঙ্কর দুর্যোগের মুখে পড়বে। সত্যি বলতে আপনার অফিসের জন্য অতিরিক্ত চাকচিক্যময় অফিস, দামী দামী ফার্নিচার, দেয়ালে দামী ক্যানভাস ইত্যাদির দরকার নাই। প্রতিষ্ঠান যদি দাঁড়িয়ে যায়, এগুলি এমনিতেই হবে। কিন্তু শুরুতেই বেশী খরচ মানে, আপনার পতনটাও সহজেই হবে। প্রাথমিক অবস্থায় আপনাকে চেষ্টা করতে হবে যেন খরচটা খুব কম হয়। হয়ত আপনার বসবার জন্য ৭৫০০ টাকা দামের চাকাওয়ালা চেয়ারের বদলে ৭৫০ টাকা দামের একটি প্লাস্টিকের চেয়ারই জুটবে তাতে, তবে এটি নিশ্চিত করবে যেন আপনি এক সময় ৭৫,০০০ টাকা দামের একটি চেয়ারে বসতে পারেন।

৩. স্টার্টআপ সংস্কৃতি তৈরী করতে না পারাঃ

বেশীরভাগ প্রতিষ্ঠানই তার ভিতরের নিজেস্ব সংস্কৃতি তৈরী করতে ব্যর্থ হয়। একটি স্টার্টআপ শুধু টাকা বা আইডিয়ার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে যায় এমনটা নয়। বরং এর পিছনে থাকে এই ‘স্টার্টআপ’ এর প্রতি প্রচন্ড ভালোবাসা, মমতা আর একে বড় করবার এক অদম্য ইচ্ছা। আপনার প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকটি ব্যক্তিই আপনার জন্য এক-একটি সম্পদ। কিন্তু সেই সম্পদ যদি আপনার প্রতিষ্ঠানকে ভালো না বাসে, তাহলে তারা দূরে সরে যেতে এতটুকুও দ্বিধা করবে না। আপনি আপনার প্রতিষ্ঠানকে যতটুকু ভালোবাসেন, আপনার কর্মীবাহিনী যদি সেই ভালোবাসা অনুধাবন না করে, কিছুটা হলেও আপনার মত করে চিন্তা না করে এবং সর্বোপরি নিজের ভালোর থেকে প্রতিষ্ঠানের ভালোর দিকে নজর না দেয়, আপনি ‘নেতা হিসাবে’ কিছুটা হলেও ব্যর্থ ধরে নিতে পারেন।

যখন আপনার প্রতিষ্ঠানের সবাই চায় আপনার প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন, তখনই সম্ভব এটিকে দিয়ে কিছু করানো। তবে এর জন্য আপনাকে জানতে হবে লিডারশীপ কিভাবে করতে হয়। আপনার প্রতিটি কর্মকর্তা কর্মচারীকে বুঝাতে হবে তাঁরা প্রতিষ্ঠানের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

৪. কার্যকরী সেলস ফানেলের অভাবঃ

এত সময়তো বললাম আপনার প্রতিষ্ঠানের একদম ভিতরের বিষয়গুলি। কিন্তু এবার আসি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে, সেলস ফানেল। একটা প্রতিষ্ঠান টিকে থাকা না থাকা নির্ভর করে এর বিক্রয়ের উপরে। আপনার সব ঠিক আছে, শুধু পণ্য বিক্রি হয় না, কতদিন টিকবেন? শুরু থেকেই আপনাকে ঠিক করতে হবে আপনার সেলস ফানেল কেমন হবে? এটিকে কার্যকর করতে হবে এমন ভাবে, যাতে সময় এবং অর্থের অপচয় কম হয়। একটি লিড পেলে সেটিকে যেন শেষ পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেন এমন দক্ষতা আপনাকে এবং আপনার বিক্রিয় প্রতিনিধিকে অর্জন করতে হবে।

আপনার হয়ত একটি চ্যানেলে পণ্য বিক্রি হয়েই যাচ্ছে, আপনি তাতেই সন্তুষ্ট, আপনি নিশ্চিত থাকেন আপনার ঘুম থেকে ওঠাটা হবে খুবই খারাপ ভাবে। হঠাৎই যদি ঐ চ্যানেলটি বন্ধ হয়ে যায়, আপনি অথৈ সাগরে পড়বেন। ক্রেতার সংখ্যা বাড়াতে হলে আপনাকে আগের ক্রেতার কাছ থেকে সোশ্যাল প্রমান, তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করতে হবে এবং নতুন ক্রেতাকে যথা সম্ভব এর সাথে পরিচিত করতে হবে। আপনার ক্রেতা যদি আপনার সাথে তৃপ্তিকর অভিজ্ঞতা অর্জন করে, তাহলে আপনি তাকে তো পাচ্ছেনই, সাথে আরও ক্রেতা পাবেন।

৫. পণ্যের এবং প্রতিষ্ঠানের মান প্রতিষ্ঠা করাঃ

প্রতিটি সফল ব্যবসা, যত ছোট বা যত বড় হোক, তার একটি মান প্রতিষ্ঠা করে। মান প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া হয়ত দ্রুত কিছু টাকা ইনকাম করা যাবে, তবে তেমন দ্রুতই শেষ হয়ে যেতে হবে। যারা তাদের ‘মান’ এর উপর নজর দেয়, তারা অবশ্যই এক সময় টাকা এবং সফলতা দেখবে, কিন্তু এদিকে নজর না দিলেই দ্রুত অল্প কিছু টাকা আসলেও তা অচিরেই শেষ হয়ে যাবে। আপনি পণ্যের মান ঠিক রাখবেন, টাকা এমনিতেই আসবে।

উদাহরণ দিতে গিয়ে ইগলু আইস্ক্রিম এর কথাই বলি। বছরের পর বছর ধরে তারা তাদের গুনগত একটি মান বজায় রেখেছে, তৈরী করেছে বিশ্বাস। ফলে আইস্ক্রিম প্রতিষ্ঠান যখন দই ফ্লেভার, ফিরনি ফ্লেভার কিংবা ম্যাংগো ফ্লেভার নিয়ে আসলো, সবাই কোন রকম চিন্তা ছাড়াই সেটি টেষ্ট করে দেখেছে। কারণ সবাই তাদের গুনগত মানে বিশ্বাসী। আবার ধরেন সিম্ফোনী হ্যান্ডসেটের কথাই। আপনার বাজেট যখন কম, আপনি কিন্তু বাংলাদেশে বসে সিম্ফোনীর মোবাইলের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। কারণ আপনি জানেন – তারা কেমন ! কিন্তু এই সিম্ফোনীর তৈরী ৫০হাজার বা তারও বেশী দামের সেট কি কিনবেন? সেটা কিন্তু ভাববার বিষয়।

মোদ্দাকথা, আপনার প্রতিষ্ঠানকে যদি আপনি এগিয়ে নিতে চান, আপনাকে বিচার করতে হবে বাস্তবতা দিয়ে, আবেগ দিয়ে নয়। যদি কখনও এমন পরিস্থিতি আসে যে ব্যবসার জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, আপনাকে সেটা নিতে হবে। আপনার টিকে থাকার লড়াই শুধুই আপনার। আপনি সফল হলে পিছন থেকে যে মানুষগুলো বাহবা দিবে, আপনার ব্যর্থতাতেও কিন্তু তারাই কটাক্ষ করবে। তাই তাদের পরোয়া না করে আপনাকে এগুতে হবে আপন গতিতে। আর হ্যাঁ, চোখ-কান কিন্তু আপনারটাই আপনাকে খুলে রাখতে হবে।

Leave a Reply