স্টার্টআপ জগতে পিটার থিয়েল এক বিখ্যাত নাম। তিনি পেপালের কো-ফাউন্ডার এবং একজন ইনভেস্টর। সিলিকন ভ্যালীর সবচাইতে সফল ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টদের একজন তিনি। এয়ারবিএনবি, ফেইসবুক, লিঙ্কডইন, প্লানাতির, এবং স্পেইসএক্স এর মতো সফল কোম্পানিগুলির প্রথম দিকের ইনভেস্টর পিটার থিয়েল।
থিয়েল এর বই “জিরো টু ওয়ান” স্টার্টআপ দুনিয়ায় সবচেয়ে পঠিত বইদের একটি। এই বইতে স্টার্টআপ বিষয়ে তিনি তাঁর ভাবনা ব্যক্ত করেছেন। বইটি খুবই গুরত্বপূর্ন। কেবল মাত্র স্টার্টআপের ফাউন্ডার এবং ইনভেস্টরদের জন্যই নয়, আধুনিক পৃথিবীর একজন মানুষ যদি টেক দুনিয়ার ব্যবসা সম্পর্কে ধারণা নিতে চান, তাহলে তার জন্য এক অবশ্য পাঠ্য বই হতে পারে জিরো টু ওয়ান।
এই বইতে চমৎকার কিছু আইডিয়া শেয়ার করেছেন পিটার থিয়েল। তার কয়েকটি মূল আইডিয়া এই লেখায় উপস্থাপন করা হলো।
১। পরবর্তী জাকারবার্গ ফেইসবুক বানাবেন না
সাধারণত মানুষ কোন ব্যক্তির সফলতা দেখে তাকে সরাসরি কপি করতে যায়। ফেইসবুকের জনপ্রিয়তা এইরকম আরো অনেক অনেক সোশ্যাল সাইট তৈরী করেছে। অনেকে প্রচুর টাকা ইনভেস্ট করেছেন, সময় দিয়েছেন এগুলিতে। কিন্তু থিয়েলের কথা হলো আপনি যদি মার্ক জাকারবার্গ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তার মতো সোশ্যাল সাইট বানাতে যান তাহলে আপনি তার কাছ থেকে আসলে শিখছেন না।
থিয়েল তার বইয়ের নাম রেখেছেন জিরো টু ওয়ান। অর্থাৎ, এটি ছিল না, জিরো থেকে ওয়ান হয়েছে।
“জিরো টু ওয়ান কোম্পানিগুলি হলো সেইসমস্ত কোম্পানি যা আগে ছিল না। পরবর্তী বিল গেটস অপারেটিং সিস্টেম বানাবেন না। পরবর্তী মার্ক জাকারবার্গ সোশ্যাল নেটওয়ার্ক কোম্পানি শুরু করবেন না। আপনি যদি এদেরটা হুবহু কপি করতে থাকেন তাহলে এদের কাছ থেকে আপনি আসলে শিখছেন না। আপনি এদের কপি করে এদের সাথে প্রতিযোগীতা করছেন বা যদি ভেবে থাকেন তাদের সাথে প্রতিযোগীতায় নেমেছেন, তাহলে আবারো আপনি তাদের কাছ থেকে শিখছেন না কিছু।”
২। প্রতিযোগীতা থেকে সাবধান
পিটার থিয়েলের অবস্থান প্রতিযোগীতার বিরুদ্ধে। একজন দার্শনিক আছেন নাম রেনে জিরার্দ। থিয়েল এই দার্শনিক দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যুবক বয়েসেই বুঝতে পেরেছিলেন প্রতিযোগীতা খুবই খারাপ জিনিস, এবং ব্যবসার জন্য তা মারাত্মক ফল বয়ে আনতে পারে।
৩। বিজনেস মনোপলির পক্ষে
থিয়েল বিজনেস মনোপলির পক্ষে। তিনি উদ্যোক্তাদের পরামর্শ দেন এমন একটি ফিল্ড খুঁজে বের করতে যা আনট্যাপড। অর্থাৎ এ নিয়ে এখনো কেউ কাজ করছে না। মাঠ ফাঁকা। থিয়েল ফাঁকা মাঠে গোল দেবার কথা বলেন না কেবল, তিনি বলেন পুরো ফাঁকা মাঠ দখল করে নিন এবং এরপর একচেটিয়া ব্যবসা করুন।
“একজন ফাউন্ডার বা উদ্যোক্তার দিক থেকে আপনি সব সময় চান আপনার ব্যবসা যেন মনোপলি করে। আপনি পৃথিবীকে এমন কিছু দিতে চান যা আর কেউ দিচ্ছে না। যেহেতু আর কেউ দিচ্ছে না তাই ব্যবসা ঘিরে আপনার প্রফিট মার্জিন বা লাভ ভালো পরিমানে থাকবে। প্রতিটি উদ্যোক্তার এমন কিছু লক্ষ্য করেই কাজ করা উচিত।”
ওয়ার্টন ম্যানেজমেন্ট প্রফেসর এডাম গ্র্যান্টের সাথে সাক্ষাৎকারে, সময়কাল ২০১৪ সালের অক্টোবর।
৪। নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখুন
নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখেন পিটার থিয়েল। তার বইয়ের ভূমিকাতেই আছে তিনি ইন্টারভিউ নেবার সময় কী জিজ্ঞেস করেন সে বিষয়ে। তিনি জিজ্ঞেস করেন, “এমন কিছুর কথা বলুন যা আপনি বিশ্বাস করেন কিন্তু অধিকাংশ লোকই এর সাথে দ্বিমত করবে?”
এই প্রশ্ন তিনি করেন ইন্টারভিউ দিতে আসা লোকটির সৎ সাহস আছে কি না দেখার জন্য। কারণ এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া সহজ না। থিয়েলের কথায়,
“এই প্রশ্ন শুনতে সহজ মনে হলেও এটা সরাসরি। আসলে এর উত্তর দেয়া খুব কঠিন। বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে কঠিন, কারন স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়ে যে জ্ঞান আমাদের শেখানো হয় তার মানুষের সম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত। এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া সাইকোলজিক্যালিও কঠিন, কারন যে উত্তর দিবে সে জানে এমন কিছু তাকে বলতে হবে যা জনপ্রিয় হবে না লোকদের মাঝে। ব্রিলিয়ান্ট রেয়ার জিনিস, কিন্তু সৎসাহস জিনিয়াসের চাইতেও কম পাওয়া যায়।”
৫। সুখী কোম্পানি তৈরী বিষয়ে
পিটার থিয়েলের বইটিতে কেবল স্টার্ট আপ প্রোগ্রামিং ইত্যাদি নিয়ে কাঠখোট্টা লেখা নেই, এটি বইটির এক চমৎকার বিষয়। থিয়েল কখনো উদাহরণ টেনেছেন শেক্সপিয়রের রোমিও এন্ড জুলিয়েট নাটক থেকে, কখনো এনেছেন কার্ল মার্ক্সের দাস ক্যাপিটালের কথা। কখনো আবার তলস্তয়ের বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন।
এবং আগেই বলেছি তিনি ফ্রেঞ্চ-আমেরিকান দার্শনিক রেনে জিরার্দ এর দ্বারা প্রভাবিত।
সুখী কোম্পানির তৈরীর ব্যাপারে থিয়েল তলস্তয়ের বিখ্যাত উপন্যাস আনা ক্যারেনিনা’র শুরুর লাইনটি তুলে ধরেনঃ
“সব সুখী পরিবারই একইরকম ভাবে সুখী,
কিন্তু প্রতিটি দুখী পরিবার ভিন্ন ভিন্ন ভাবে অসুখী।”
থিয়েল বলেন তলস্তয়ের এই কথাটি মানুষের পরিবারের জন্য। কিন্তু ব্যবসার জন্য এই কথাটি ঠিক উলটা। ব্যবসার ক্ষেত্রে সব অসফল কোম্পানিগুলি একইরকমভাবে অসফল হয়েছে, তারা প্রতিযোগীতা এড়াতে পারে নি। তাদের গল্পগুলি একই। কিন্তু সফল কোম্পানিগুলির গল্প ভিন্ন ভিন্ন। তারা ভিন্ন ধরণের বিষয় নিয়ে শুরু করেছে এবং সেই ফিল্ডে মনোপলি ব্যবসা করেছে তাই তারা সফল।
৬। গোপনীয়তা
সফল কোম্পানিগুলি তার গোপন তথ্য ভেতরে রাখে, এ নিয়ে বাইরে কথা বলে। কোন ফিল্ডে সে মনোপলি ব্যবসা করছে তাও গোপন রাখতে চায়। থিয়েলের মতে এই গোপনীয়তা খুবই গুরুত্বপূর্ন এবং এর উপরেই কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠিত থাকে।
এখানে আমার মনে পড়ছে ক্রিস্টোফার নোলানের প্রেস্টিজ ফিল্মের কথা। ম্যাজিশিয়ান বা যাদুকরদের জন্য তাদের ম্যাজিক ট্রিকসের গোপনীয়তাই সবচাইতে দরকারী। যদি এই গোপনীয়তা প্রকাশ হয়ে যায় তাহলে ম্যাজিক তার রহস্য হারায় ও মূল্যহীন হয়ে পড়ে।
সফল কোম্পানির ফাউন্ডারেরাও এরকম ম্যাজিশিয়ানদের মতো, অনেক গোপনীয়তা বয়ে বেড়ান। যা তারা কখনো প্রকাশ করেন না কারণ প্রকাশ হলেই তাদের ম্যাজিক শেষ হয়ে যেতে পারে।
এর থেকে আরেকটা জিনিসও বুঝা যায় কেউ তার মূল গোপন তথ্য আপনাকে বলবে না। আপনার কোম্পানির গোপন তথ্য আপনাকেই বের করতে হবে এবং তাকে রক্ষা করে যেতে হবে।
- Written by: bdpreneur
- Posted on: July 30, 2018
- Tags: উদ্যোগ, জিরো টু ওয়ান, নতুন ব্যবসা, বিজনেস আইডিয়া, স্টার্টআপ