ব্যবসায় কম্পিটেটিভ এডভান্টেজ : কেসস্টাডিতে সহজপাঠ

আমাদের নবীন উদ্যোক্তাদের অনেকেই একটি বিষয়ে ধারনা রাখেন না। এটি হচ্ছে কম্পিটেটিভ এন্ডভান্টেজ-সোজা বাংলায় বললে অন্যের তুলনায় আপনার প্রোডাক্ট কেনার সুবিধাটা কী?  এই সুবিধাটাই হচ্ছে আপনার প্রতিযোগিতার যোগ্যতা বা কম্পিটেটিভ এডভান্টেজ। আমাদের সাধারণ ধারণা হচ্ছে অন্যেরা যেহেতু একই জিনিস বানায় আমিও বানালাম-তাহলে আমারটাও বিক্রি হবে। ব্যবসা আসলে এরকম সরলীকরনে চলে না।

কম্পিটেটিভ এডভান্টেজ কীভাবে খুঁজে বের করবেন?
যে কোনো প্রোডাক্ট সেটি যদি আগে থেকেই বাজারে থেকে থাকে, তাহলে উদ্যোক্তাকে প্রথমেই নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে, ‘অন্য প্রোডাক্ট রেখে আমার প্রোডাক্টটি লোকজন কেন কিনবে।’ এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন, এর জবাব যখন পরিস্কার হয়ে যাবে, তখন আপনার পক্ষে ব্যবসা করা সহজ হয়ে যাবে।আপনার প্রোডাক্টটি কেন কিনতে পারে, তার অনেকগুলো কারন থাকতে পারে। যেমন, ১. অন্যের তুলনায় আপনার পণ্যের দাম কম।২. দাম সমান কিন্তু গুনগত মান বেশি।৩. দাম বেশি কিন্তু গুনগত মান অনেক বেশি ভালো যেটিতে শেষ বিচারে ক্রেতা লাভবান হবেন।৫. আপনারটার ডিজাইন ইউনিক এবং অন্যের তুলনায় সেটি বেশি আকর্ষণীয়।৬. আপনার ডেলিভারি অন্যের তুলনায় দ্রুত।৭. আপনার বিক্রয় পরবর্তী সেবা দেয়ার সামর্থ বেশি।৮. আপনি অন্যের তুলনায় বেশি পরিমান বা বেশি মেয়াদে বাকি দিতে পারেন ইত্যাদি।এখন কথা হচ্ছে আপনি সবগুলো কম্পিটেটিভ এডভান্টেজ একসঙ্গে নিতে পারবেন না। মানও ভালো অথচ দামেও কম-এটি আসলে সম্ভব নয়। মান ভালো করতে হলে ভালো মেশিনারী লাগবে, ভালো কাঁচামাল লাগবে-তখন দাম কমিয়ে রাখা সম্ভব নয়। একই ভাবে যিনি বিক্রয় পরবর্তী সার্ভিস দিতে সময় ও পয়সা খরচ করবেন, তিনি কম দামে দিতে পারবেন না।কিন্তু উদ্যোক্তাকে দেখতে হবে এর মাঝে কতবেশি কম্পিটেটিভ এডভান্টেজ তিনি দখল করতে পারেন এবং কতবেশি এডভান্টেজ তিনি খুঁজে বের করতে পারেন-এই সম্ভাবনা আনলিমিটেড, যতবেশি সুবিধা তিনি তৈরি করতে পারবেন তত বেশি তিনি অন্যের তুলনায় এগিয়ে থাকবেন। যদি কম্পিটেটিভ এডভান্টেজ না থাকে, তাহলে সে ব্যবসায় না যাওয়াই উচিত।

একটি কেসস্টাডি:এখন আমরা বুঝার জন্য একটি কেসস্টাডি নিব। এই লেখাটি আমাদের গ্রুপেই পোস্ট করেছেন আমাদের এক বন্ধু।  প্রথমে তাঁর হতাশামাখা স্ট্যাটাসটির প্রয়োজনীয় অংশটি পড়া যাক:

উনার সঙ্গে আমার আপকামিং একটা প্রোডাক্টের প্রাইস ফিক্সিং নিয়ে দরকষাকষি চলছে। মানে আমি প্রোডাক্টটা উনাকে গছাতে চাইছি। উনি ও খুব আগ্রহী। তো কথা বার্তা চলছে…………

ব্যবসায়ীঃ ইন্ডিয়ার অমুক ব্র্যান্ডের মাল ৮ মাস লাস্টিং করে, চায়নার অমুক ব্র্যান্ডের মাল ৬ মাস লাস্টিং করে। আপনারটা যদি ৫ মাস ও লাস্টিং করে তাইলেও চলবে। সব আমি নিমু, আর কাউরে দিতে পারবেন না।আমিঃ আচ্ছা ঠিক আছে। আমি আগে স্যাম্পল দিবো, আপনি টেস্ট করে দেখে তারপরে যদি কোয়ালিটি আপনার মনঃপুত হয় তাইলে তো নিবেন? এখন রেট কত করে দিবেন বলেন।ব্যবসায়ীঃ কত করে দিলে আপনার পোষাবে?আমিঃ আমারে তো যত বেশী দিবেন তত বেশী আমার পোষাবে। আমার পোষানোতে আপনার কি আসে যায়। আপনি যে আমারে খয়রাতী দিবেননা সেইটা আমি জানি।ব্যবসায়ীঃ ঠিক আছে, যদি ৫/৬ মাস লাস্টিং করে তাইলে প্রতি সেট ৪০০ টাকা করে দিমুনে। প্রোডাকশন সব আমাকে দিয়ে দিবেন।আমিঃ কি বললেন ? ? ?…………………… মার্কেটে এই মালের হোলসেল প্রাইস সবচেয়ে কমদামিটা ৮৫০ টাকা! যেটা রিটেলে ১০০০/ ১১০০ টাকা করে বিক্রি হয় আর আমাকে এত কম দাম দিবেন অফার করতেছেন?ব্যবসায়ীঃ আরে জাহান্নামে ফালান মার্কেটের রেট। এই দেখেন ইন্ডিয়া থেকে আমি কত দামে মাল আনতাছি ( বলে একটা ফাইল বের করে রেট দেখালো – ৬৮০ টাকা)।আমিঃ এইটাতো তাদের এফওবি রেট। মালের কেরিং কস্ট্‌, ট্যাক্স ডিউটি এগুলো যোগ করলে তো এমনিতে ৮৫০ টাকা দাম হয়ে যায়। তাইলেতো হোলসেল রেট আরো বেশী হওয়ার কথা। ও আচ্ছা, আপনারাতো ডিউটি ছাড়া এক বিশেষ কুদরতি পদ্ধতিতে মাল আনেন জানি। তো এখন এক কাজ করেন, আপনি ইন্ডিয়ার মালের এফওবি রেটের চেয়েও ২৫% কম দেন, তাইলেও আমার চলবে।ব্যবসায়ীঃ না ভাই, আমার পোষাবে না। আচ্ছা যান আরো ২০ টাকা করে বাড়াইয়া দিমুনে (এমনভাবে বললেন যেনো খয়রাত দিচ্ছেন)।আমিঃ দেখেন ইন্ডিয়ায় র’মেটেরিয়াল, নিজেদের। তাদের র’মেটেরিয়ালের চেয়ে আমার র’মেটেরিয়াল কস্টিং বেশী। সেইম কোয়ালিটি চান অথচ দাম দিতে চান তাদের চেয়ে অর্ধেক। এইটা কেমন ন্যায্যতা? তাইলে আমি কোয়ালিটি ডাউন করে দেই, দাম যা বলছেন তার চেয়েও কম দিয়েন।ব্যবসায়ীঃ আরে ফালায়ে থোন মিয়া ন্যায্যতা। ইন্ডিয়ার চেয়ে অর্ধেক দামে দিতে না পারলে ফ্যাক্টরী দিতে গেছেন ক্যান? আপনে কি ব্যবসা এতো সোজা মনে করছেন?

এবার দেখা যাক এই ব্যবসার কম্পিটেটিভ এডভান্টেজের মামলা:
এই কুৎসিত ব্যবসায়ীটির আলাপটি খেয়াল করুন। তিনি কী চাইছেন? সহজ কথায় ‘অবিশ্বাস্য কম দাম’।এর বিপরীতে উদ্যোক্তার যুক্তিগুলো কী কী সেটাও খেয়াল করুন।কিন্তু ব্যবসায়ী বলছেন, ( আলাপের শুরুতেই) “ইন্ডিয়ার অমুক ব্র্যান্ডের মাল ৮ মাস লাস্টিং করে, চায়নার অমুক ব্র্যান্ডের মাল ৬ মাস লাস্টিং করে। আপনারটা যদি ৫ মাস ও লাস্টিং করে তাইলেও চলবে…যদি ৫/৬ মাস লাস্টিং করে তাইলে প্রতি সেট ৪০০ টাকা করে দিমুনে। প্রোডাকশন সব আমাকে দিয়ে দিবেন।”তাহলে এখানে আপনার সুযোগটি কোথায়? ঐ যে, ব্যবসায়ী এখানে মান নিয়ে চিন্তিত নন। ইন্ডিয়ার ‘মাল’ যদি ৬ মাস লাস্টিং করে, তাহলে এই উদ্যোক্তারটা ‘৫ মাস লাস্টিং’ করলেই তিনি খুশি। সেক্ষেত্রে দাম ইন্ডিয়ারটার তুলনায় অনেক কম করে দিতে হবে এবং বিনিময়ে তিনি পুরো প্রোডাকশন কিনে নেয়ার অফার দিচ্ছেন-ব্যবসার দিক থেকে একটি বড় সুযোগ।

এখন উদ্যোক্তা কী করতে পারেন?-
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে বাজারে সুযোগ তৈরি হচ্ছে ‘কমদামে এবং তুলনামূলক কম মানসম্পন্ন’ প্রোডাক্টের বড় ক্রেতা আছে। বিনিময়ে সব পন্য বিক্রির নিশ্চয়তা আছে।এখন উদ্যোক্তা যদি এই সমস্যার সমাধান করতে পারেন যেখানে তিনি পন্যের মান কমিয়ে দাম কমিয়ে এই নিশ্চিত ক্রেতার সঙ্গে ডিল করতে পারেন, তাহলে তিনি একটি ব্যবসা পেলেন।এটাই হচ্ছে কম্পিটেটিভ এডভান্টেজ চিহ্নিত করে সেই অনুযায়ী কাজ করা।এখন এমনও হতে পারে যে এই রেটে উদ্যোক্তার আসলে মান নামানোর পরেও পোষাবে না। সেক্ষেত্রে ব্র্যান্ডিং করে, নিজস্ব চ্যানেল তৈরি করে কম্পিটেটিভ এডভান্টেজ তৈরি করতে হবে। অন্য অনেকগুলো বিকল্প নিয়ে কাজ করতে হবে এবং সবচাইতে যুক্তিসঙ্গত টিকে বেছে নিতে হবে।উদ্যোক্তা একটু ভালো দামের জন্য এই ব্যবসায়ীর প্রতিযোগির কাছে যেতে পারেন, এই ব্যবসায়ী যাদের কাছে পন্য বিক্রি করেন সরাসরি তাদের কাছে যেতে পারেন। এভাবে একেকটা স্টেপ কমিয়ে তিনি চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু যেভাবেই হোক, একটি কম্পিটেটিভ এডভান্টেজ অফার না করলে তাঁর পক্ষে ব্যবসা চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হবে একথা নিঃসন্দেহে বলে দেয়া যায়।

লেখা : আরিফ জেবতিক
প্রকাশ : চাকরি খুঁজবো না চাকরি দেব গ্রুপ।

Leave a Reply