প্রচার, প্রসারের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম : ওয়ার্ড অব মাউথ

অপর্ণা সেনের সম্পাদনায় আনন্দবাজার গ্রুপের সানন্দা বেরুচ্ছিল তখন। পাতা জুড়ে বড় বড় বাহারি বিজ্ঞাপন। এর মধ্যে চোখে পড়ল শাড়ির দোকানের বিজ্ঞাপন। কয়েক সংখ্যা ধরে পর পর এবং কয়েক পৃষ্ঠাব্যাপী। কলকাতা মানেই পর্যটকদের কাছে শাড়ির আকর্ষণ। কলকাতা জুড়ে এখন শাড়ির দোকান। কিন্তু তখন নিউমার্কেট, পার্ক স্ট্রিটের কিছু দোকান, যাদবপুর আর বড়বাজারের কিছু দোকান ছিল শাড়ি বিক্রি-বাট্টার জন্য বিখ্যাত। সানন্দার বিজ্ঞাপনে কয়েক পাতা জুড়ে যে দোকানটির কথা উল্লেখ করা হয়েছিল তা দেখে চোখ আটকে গেল কারণ দোকান টি ছিল ঐ জায়গা গুলো থেকে আলাদা একটা জায়গা। অন্য একটা ঠিকানা। বিড়লা প্ল্যানেটরিয়ামের উল্টোদিকে একটা নতুন মার্কেট হয়েছিল। সেই মার্কেটের মধ্যে ছিল দোকানটি। সেই বিজ্ঞাপনের বাহার দেখে কণা বলল, ওই দোকানে একবার যেতে হবে। শাড়ির ওপর এত সুন্দর সুন্দর প্রচার দিচ্ছে ওরা, নিশ্চয়ই ভালো জিনিস মিলবে ওখানে হাজির হলে! আমরা তখন কলকাতায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। একদিন বিকেলে কণা ঢুঁ দিল সেখানে, সঙ্গে আমিও। মার্কেট টায় ঢুকে ভুরু কুঁচকে গেল। নতুন উদ্বোধন হওয়া মার্কেট টিতে নানা রকমের দোকান ছিল। কিন্তু শাড়ির দোকান ছিল ঐ একটাই! একটা মার্কেটে একটা শাড়ির দোকান। এক দোকান করেই এত বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি! মনে মনে একটু বিস্মিত হলাম। দোকানে ঢুকলাম। ছিমছাম, সাজানো, গোছানো। দেখলাম, এক মাড়োয়ারি দম্পতি দোকান চালাচ্ছেন। ভদ্রলোকের বয়স মনে হল পঞ্চাশের নিচে। ভদ্রমহিলার বয়সও কাছাকাছি হবে। কণা শাড়ি দেখার আগেই প্রশ্নটা করে ফেলল, ‘যদিও প্রচুর শাড়ির স্টক দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু নতুন এক দোকান করে এত এত বিজ্ঞাপন করছেন! পোষাবে?’ ভদ্রমহিলা ওনার ঝকঝকে দাঁতগুলো বের করে হাসলেন, ‘বিজনেস মানেই রিস্ক। বিজনেস মানেই ইনভেস্টমেন্ট। ওইভাবে ম্যাসিভ প্রচার না করলে সবার চোখে পড়ত না। এই যে আপনারা চলে এসেছেন, বিজ্ঞাপন না দেখলে তো পুরনো দোকানেই ঢুকতেন। মনে হচ্ছে আপনারা বাংলাদেশ থেকে বেড়াতে এসেছেন। তাই না?’ ভদ্রলোক আমায় বললেন, এত শাড়ি একবারেই একসঙ্গে দোকানে তুলতে পেরেছি কারণ আমাদের একটা অ্যাডভানটেজ আছে। শাড়ির ব্যবসাটা আমাদের অনেকদিনের। আগে আমরা শাড়ি সাপ্লাই করতাম। এখন আমরা নিজেরাই দোকানটা করে ফেললাম।‘ ‘প্রচারেই প্রসার। বুঝলাম সে জন্যেই বিজ্ঞাপন করছেন বেশি বেশি। কিন্তু সানন্দায় এত বিজ্ঞাপন করার আইডিয়াটা এলো কোত্থেকে?’ আমার প্রশ্ন ছিল তার কাছে। ভদ্রলোক বললেন, ‘আসলে ভেবে দেখলাম বাঙালিরাই শাড়ির আসল ক্রেতা। সানন্দা কাগজটি বাঙালিদের পছন্দ। সে জন্য ডেইলি পেপারে না গিয়ে ম্যাগাজিন বেছে নিয়েছি। তাতে দেখা যাচ্ছে প্রচুর লোকজন আসছে।’ কিছু শাড়ি বেছে বেছে কিনে ফেলল কণা। স্টকে পছন্দ করার মতোই অনেক কাপড়। দামও তুলনামূলকভাবে বেশি নয়। শাড়ি গুলো প্যাকেটে ভরে দিলেন না উনারা। বললেন ফলস লাগিয়ে দেওয়া হবে প্রতিটি শাড়িতে। সে জন্য একদিন পরে হোটেলে পৌঁছে দেওয়া হবে। ফলস লাগানো ও ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য কোনো এক্সট্রা চার্জ ধরা হবে না। এ ধরনের ছোট ছোট সার্ভিস দিয়েই ক্লায়েন্টদের মুগ্ধ করার পদ্ধতিটা ওদের বেশ রপ্ত বুঝতে পারলাম। আমরা যখন হাসিমুখে দোকানটা থেকে বেরুচ্ছি, সেই সময় একটা বাচ্চা দৌড়ে এল। ১০-১২ বছর বয়স হবে ছেলেটির। দোকানদার মহিলার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল ছেলেটি। ফুলের মতো ফুটফুটে। অল্প কিছুক্ষণ শুনেই বুঝলাম, এই শাড়ির দোকানে আসতে, থাকতে বা কাজ করতে কিশোরটির একদম ভালো লাগছিল না। জিজ্ঞেস করলাম, কার ছেলে? ভদ্রলোক হেসে বললেন, আমাদের ছেলে। কণা বলল, ‘এ সময়ে ও এখানে কেন? স্কুল নেই?’ ভদ্রমহিলার উত্তর, ‘স্কুলে গিয়ে কী করবে?’ ‘পড়াশোনা করবে!’ ‘তা তো করবে। মিনিমাম লেখাপড়া তো ওকে আমরা করাবোই। তারপর?’ ‘তারপর মানে?’ কণা অবাক সঙ্গে আমিও। কণা প্রশ্ন করল, ‘মিনিমাম কেন? ম্যাক্সিমাম না কেন?’ ভদ্রমহিলার ঠোঁটে হাসি, ‘ম্যাক্সিমাম পড়াশোনা করে কী হবে? ধরুন পড়াশোনা করল। তারপর কী হবে? ক্যারিয়ার তো? সেটা তো চাকরির বদলে বিজনেস করলেও হয়। হয় না? লক্ষ্য তো একটাই। নিজের পায়ে দাঁড়ানো। ভালো উপার্জন। সুস্থ জীবনযাপন। এই তো?’ মাথা নাড়লাম আমরা। উনার কথায় যুক্তি আছে। ভদ্রমহিলার কথা, ‘কাজেই ছোটবেলা থেকে যদি আমাদের ছেলেটিকে শাড়ির মধ্যে রেখে দিই, তাহলে শাড়ির ব্যাপারে ওর যে পরিষ্কার ধারণা হবে, যে এক্সপার্ট নলেজ সরাসরি তৈরি হবে, সেটা তো জেনারেল স্কুল-কলেজের বিশাল পড়াশোনা থেকে পাওয়া যাবে না। যাবে?’ ভদ্রলোক বললেন, ‘সুতরাং আমরা ঠিক করেছি, স্কুল-কলেজের এডুকেশনের পাশাপাশি আমাদের ছেলেটিকে ছোটবেলা থেকেই শাড়ির ব্যবসার মধ্যে রেখে দেব। তাতে প্রথম প্রথম তার একঘেয়ে মনে হবে। একটা সময় অভ্যস্ত হবে। তারপর আনন্দ পাবে। তারপর এক্সপার্ট হয়ে উঠবে। যে স্পেশালিটি ওর ক্যারিয়ার শক্ত করে দেবে।’  ‘এবং তাই হচ্ছে কিন্তু। শাড়ি দেখছে, বুঝছে, শাড়ি সম্পর্কে জানছে। এখনই ওকে জিজ্ঞেস করুন কোনটা কী শাড়ি? কোথায় তৈরি হয়? কী দিয়ে বানায়? কারা বানায়? কোত্থেকে আসে? সব গড় গড় করে এক্ষুনি বলে দিতে পারবে। জিজ্ঞেস করুন কোন শাড়িটা আপনাকে মানাবে। সে বলে দেবে কিন্তু!’ নিজ পুত্রের সম্পর্কে কথাগুলো বললেন ভদ্রমহিলা। জানতে চাইলাম, ‘ওর কী নাম?’ ‘মিকি।’  ‘মিকি! বেশ আনকমন নাম।’  ‘হ্যাঁ। আমাদের ছেলে টেলিভিশনে অনেক কার্টুন ছবি দেখে। সেখান থেকে আমরা নামটা নিয়েছি।’ আমার মনে হল, ছেলেটি কার্টুনের চরিত্রের মতো সামনে দিয়ে যে ছোটাছুটি করে বেড়ায় সেটা তারা পছন্দ করেন। সেই পছন্দের প্রতিফলন ওই নামের মধ্যে। ওই দিনের পর সময় গেছে অনেক। মাঝে চলে গেল অনেক বছর। আমরা যে বছরই কলকাতা গিয়েছি, একবারের জন্য হলেও ঢুকেছি সেই দোকানে। কমবেশি শাড়ি কিনেছে কণা। তাই মিকিকে চোখের সামনে বড় হতে দেখলাম আমরা। দেখলাম, শুধু গায়ে গতরে, দেখতে শুনতে বড় হল না মিকি, শাড়ি সম্পর্কে আশ্চর্য রকমভাবে প্রচুর পড়াশোনাও তার এত বছরে হয়ে গেছে। ইন্টারনেট ঘেঁটে, স্যাটেলাইট টিভি ইনফরমেটিভ চ্যানেল দেখে, বিশেষ টাইপের বই পড়ে মিকি শাড়ি সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা অর্জন করছে। কোন ধরনের শাড়ি কোথায় অর্ডার দিয়ে কোত্থেকে আনতে হবে, বিয়ের সময় কেমন শাড়ি বেশি আকর্ষণ, কোন শাড়ির কেমন কোয়ালিটি, রং, বুনন, সুতো সবকিছু প্রায় নখদর্পণে ওর। শাড়ি সম্পর্কে মিকিকে রীতিমতো একটা অভিধানের মতো হয়ে যেতে দেখলাম। আমরা যতবার ঐ দোকানে গিয়েছি, ততবার মিকির সঙ্গে কথা বলেছি দীর্ঘক্ষণ। মজা পেয়েছি কথা বলে। বুঝতে পারলাম এর মধ্যে, কলকাতার প্রায় সব বড় শাড়ির স্টোরের লোকজন মিকিকে চেনে এক নামে। ততদিনে পার্ক স্ট্রিটে আর দক্ষিণাপণে ওদের আরও দুটো বড় দোকান হয়ে গেছে। শাড়ি সম্পর্কে অনেকেই মিকির কাছে ফোনে সাজেশন চায়। সেসবও দেখলাম। ১৮-১৯ বছরের একটি ছেলে সারা কলকাতার এক ‘বিশেষ নাম’ হয়ে গেল। কখনও এমন হয়েছে , আমাকে যখন একা কলকাতায় আসতে হয়েছে, আমি কণার জন্য শাড়ি নিয়ে গিয়েছি। পরের যাত্রায় মিকির কাছে অনুযোগ করেছি, সেবারের তিনটা শাড়ি কণার পছন্দ হয়নি। শুনে মিকি হেসেছে, বলেছে, ‘যখন নিয়েছিলেন তখন নিশ্চয়ই আমি দোকানে ছিলাম না। আমি জানলে ওগুলো কিনতে দিতাম না। কণা ভাবির কোন রংয়ের ওপর কোন প্রিন্ট পছন্দ, কোন বুনন পছন্দ সেটা তো আমি জানি। এ দুটো নিয়ে যান। পছন্দ না হলে আমাকে পরেরবার এসে মার দেবেন। আর পরেরবার আগের শাড়িগুলো অবশ্যই ফেরত নিয়ে আসবেন। নতুন কাপড়ের সঙ্গে এক্সচেঞ্জ করে দেব। সমস্যা নেই। মিকি আমার কাছে ক্রমশ এক অভিনব চরিত্র হয়ে উঠল। শাড়ি নিয়ে তার বিশেষত্ব, বিজনেস স্ট্র্যাটেজি, আচার-ব্যবহার সব দেখতে দেখতে মনে হল, তাকে যে তার মাড়োয়ারি বাবা-মা জজ-ব্যারিস্টার বানানোর চেষ্টা না করে ‘শাড়ি বিশেষজ্ঞ’ বানাল সেটাই কি ঠিক? ঠিক নয়? মানুষের জীবন তো একটাই। হাজারো অ্যাভারেজের ভিড়ে মানুষের হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে কি কোনো বাহাদুরি আছে? একজন মানুষের ‘জ্যাক অব অল ট্রেড’ হওয়া বেশি জরুরি, নাকি ‘মাস্টার অব সামথিং’ হওয়াটা প্রয়োজনীয় বেশি? সেই মিকি একসময় বিয়ে করে। পিএইচডি করা মেয়ে। ওরা দাম্পত্যে অনেক সুখী অথচ চিন্তাভাবনা, জীবনযাপন, ব্যস্ততায় কোথাও কোনো মিল নেই দু’জনের। বিষয়টি মিকিকে ভাবায় এখন। তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কীভাবে গড়ে তুলবে মিকি নিশ্চিত নয়। বাবার দর্শন, নাকি মায়ের আদর্শ। মা নিশ্চয়ই চাইবে, তাদের সন্তান তার মতো পিএইচডি করুক, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হোক। তখন তো মিকি বাধা দিতে পারবে না। কিন্তু সেটাও কি ঠিক হবে? শেষবার দেখা হয়েছিল, মিকি আমার কাছে এই প্রশ্ন করেছিল। আমি কোনো উত্তর দিইনি। কারণ এই প্রশ্নের যথার্থ উত্তর তো আমার কাছেও নেই।

ফরিদুর  রেজা  সাগর
লেখক : শিশুসাহিত্যিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

Leave a Reply