“ধীরুভাইজম” ! রিলায়েন্স কর্ণধার ধীরুভাই আম্বানি’র বানিজ্য দর্শন

ধীরুভাই আম্বানি ভারতীয় কর্পোরেট উপাখ্যানের একজন কিংবদন্তী। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন Reliance Group এর মত এক বিশাল সম্রাজ্য। বহুদিন ধরে তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন এ.জি. কৃষ্ণমূর্তি। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি লিখেছেন “ধীরুভাইজম” বইটি। বইটিতে অসামান্য দক্ষতার সাথে তিনি তুলে ধরেছেন ধীরুভাই এর ব্যবসায়িক দর্শন এবং কৌশলগুলো। বইটির একটি রিভিউ পাওয়া গেল এখানে

Future Startup এর পক্ষ থেকে অনুবাদ করা হলো রিভিউটি –

ধীরুভাই আম্বানির জন্ম ১৯৩২ সালের ৮ ডিসেম্বর, গুজরাটের প্রত্যন্ত গ্রামের একজন স্কুলশিক্ষকের ঘরে। মেট্রিকুলেশন দেয়ার পর ১৭ বছর বয়সে তিনি ইয়েমেনের বন্দর এডেন এ চলে যান কাজ করতে। এর নয় বছর পর তিনি ভারতে ফিরে আসেন এবং রিলায়েন্স কমার্শিয়াল কর্পোরেশন নামে একটি ট্রেডিং ব্যবসা শুরু করেন। প্রথমে মসলা তারপর সুতার ট্রেডিং করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি উৎপাদনের দিকে চলে যান শুরু করেন টেক্সটাইল ম্যানুফাকচারিং।এরপর তিনি ক্রমাগত হাত বাড়িয়েছেন সুতা, পলেস্টার, পেট্রোকেমিকেলস, তেল এবং গ্যাস ইত্যাদি ইন্ডাস্ট্রির দিকে।

ভগবত গীতায় বলা হয়েছে “একজন মহৎ মানুষের কাজ অন্যদেরক উৎসাহিত করে। তিনি যাই করেন তা অন্যদের অনুসরণ করার মতো একটি মানদণ্ডে পরিণত হয়।” ধীরুভাই এর জীবন এই কথার উজ্জ্বল উদাহরণ।

তাঁর কর্পোরেট দর্শন ছিল – “Think big. Think differently. Think fast. Think ahead. Aim for the best. Ideas are no one’s monopoly.”

তিনি বিশ্বাস করতেন “সীমাবদ্ধতা বাস্তবে থাকে না, থাকে মানুষের মনে”। তিনি তার টিমকে প্রায়ই বলতেন, “এই কাজ করা কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়।“ তিনি বলতেন “চোখ খুলে স্বপ্ন দেখ”

ভিশন নাগালের ভিতরে থাকতে হবে, হাওয়ায় ভাসলে চলবে না। এটি অবশ্যই অর্জন করার মত হতে হবে।

তিনি একজন উদারনীতিক নেতা ছিলেন। তিনি সবসময় মানুষকে কাছে ডাকতেন তাদের চিন্তা-ভাবনা, আইডিয়াগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। তিনি যখন তাদের কথায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু পেতেন তাহলে সাথে সাথেই তিনি নিজেরটা বাদ দিয়ে তা গ্রহণ করতেন। এটা নিয়ে কখনোই তিনি মনঃক্ষুণ্ন হতেন না। এটি তাঁর এমন একটি গুণ যা বেশিরভাগ মানুষের পক্ষে চর্চা করা কঠিন।

তিনি বলতেন “আমাদেরকে বিশ্বাস করতে শিখতে হবে। কয়েক শতাব্দী ধরে ভারতীয়দের ব্রেইনওয়াশ করা হয়েছে আর একজন ভারতীয়কে অবিশ্বাস করতে। এটি জাতীয় শক্তি দুর্বল করে দেয়। অনাস্থা উদ্যোগকে হত্যা করে। অনাস্থা মানুষকে ম্যানিপুলেট করতে, খারাপ কৌশল নিতে বাধ্য করে। আস্থা এবং স্বচ্ছতা ব্যবসায় উদ্যোগকে উৎসাহিত করে।”

তাঁর শেখার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। তাঁর ছিল ক্ষুরধার ইন্সটিঙ্কট । বহুদিনের পড়াশোনা, মার্কেট ট্রেন্ড নিয়ে গবেষণা, মার্কেটের দিকে সতর্ক নজর রাখা এবং তাঁর ভবিষ্যত দেখার প্রবণতা – এইসব চর্চার বদৌলতে তিনি এই ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন।

কোনো প্রজেক্ট চলাকালীন যে কোনো সময়ে প্রজেক্ট সম্পর্কে যাবতীয় খুঁটিনাটি  তিনি টিমের অন্য সদস্যের চেয়ে বেশি জানতেন। যে এরিয়াতে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই সেই এরিয়াতে কাজ করতে এবং সেখান থেকে নতুন কিছু শেখার ব্যাপারে তার আগ্রহ ছিল অপরিসীম। কোনো উদ্যোগ নেয়ার সময় তিনি হোমওয়ার্ক করতেন। এই হোমওয়ার্কের ব্যাপারে যদি একবার তার আত্মবিশ্বাস জন্মে তিনি সাহস করে সেই উদ্যোগ নিয়ে ফেলতেন, তা একদম নতুন ইন্ডাস্ট্রি হলেও। তার এই সাহস অভিযাত্রীর চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না।

চাহিদা বাড়ানোর জন্য আগে সরবরাহ বাড়াতে হবে – এরকম অপ্রচলিত থিওরিতে তিনি বিশ্বাস করতেন। তিনি কাজের গতি এবং দক্ষতায় বিশ্বাস করতেন। তিনি অবিরত এবং দ্রুত প্রযুক্তির উন্নয়ন করতেন, মার্কেট থেকে ইনোভেটিভ উপায়ে অর্থ সংগ্রহ করতেন এবং তার প্লান্টে বিনিয়োগ করে প্লান্টের উৎপাদনক্ষমতা বাড়াতেন এবং এই সব কাজ করতেন একসাথেই।

তিনি বিশ্বাস করতেন “একটি খারাপ পণ্য শুধু ক্লায়েন্ট এবং কাস্টমারদেরকে অসন্তুষ্ট করে না তাদেরকে প্রতিযোগীদের দ্বারস্থ হতেও উৎসাহিত করে। এবং যদি আসলেই এরকম কিছু হয় তাহলে ব্যবসায়িকভাবে তা ডেথ ওয়ারেন্টে স্বাক্ষর করার শামিল। কিন্তু অন্যদিকে একটি ভালো পণ্য ব্যক্তিগত অ্যামব্যাসেডর হিসেবে কাজ করে এবং ক্লায়েন্ট ও কাস্টমারদের সাথে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক তৈরি করতে সহায়তা করে।“

তিনি বলেন, “আপনি যদি দৃঢ়প্রতিজ্ঞা নিয়ে কাজ করেন এবং কাজটি একদম ঠিকভাবে করার ব্যাপারে সচেষ্ট হন সাফল্য আপনার দিকে ধাবিত হবে।”

তিনি উদ্যোক্তাদেরকে অর্থের চেয়ে পণ্যের উপর বেশি গুরুত্ব দেয়ার কথা বলেন। তিনি বলেন “অর্থ পণ্যের মূল্য। অর্থ কোনো পণ্য নয়, কখনো পণ্য হতে পারে না।”

“আপনার টিমকে যথাযথ পরিবেশ দিন। তাদেরকে প্রেরণা দিন। তাদেরকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করুন। তাদের প্রত্যেকেই অসীম শক্তির অধিকারী, তারা তাদের সবটুকু ঢেলে দেবে আপনার জন্য। এটি এক ধরণের বাজি।”

ধীরুভাই অরবিট থিওরিতে বিশ্বাস করতেন। তিনি বলতেন “রিলায়েন্সে প্রবৃদ্ধির কোনো সীমা নেই। আমি আমার ভিশন সবসময়ই রিভাইস করি। আপনি যখন স্বপ্ন দেখা শুরু করবেন তখনি আপনি তা করতে পারবেন।”

“আশা হলো সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। অনেক কঠিন সময়ও আপনার লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হোন, প্রতিকূলতাকে সুযোগে রূপান্তরিত করুন। আশা ছাড়বেন না, সাহসে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।”

তিনি তরূণ উদ্যোক্তাদের দুঃসময়ের কাছে পরাজিত না হওয়ার পরামর্শ দেন। আশা, আত্মবিশ্বাস এবং সাহসের সাথে নেতিবাচক শক্তিগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানানোর কথা বলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন এম্বিশন এবং উদ্যোগেরই জয় হয় শেষ পর্যন্ত, নতুন সহস্রাব্দে ভারতের পরিবর্তনে মূল অবদান রাখবে তরুণ উদ্যোক্তাদের সাফল্য।

Leave a Reply