একটি সফল স্টার্টআপের জন্য কী জরুরী? কীভাবে একটি সফল স্টার্ট আপ শুরু করা যায়? এ নিয়ে ব্যক্তিগত ভাবে আমি কিছু বলতে পারি না, কারণ সফল স্টার্টআপের কোন অভিজ্ঞতা আমার নেই। তাই আমি বলছি পল গ্রাহাম এর উপর ভিত্তি করে। তিনি হার্ভার্ড কম্পিউটার সোসাইটিতে কিভাবে একটি সফল স্টার্টআপ শুরু করতে হয় এ নিয়ে একটি লেকচার দেন। সেই লেকচার থেকেই এই লেখার সূচনা।
বাংলা সাহিত্যের দূর্বোধ্যতম লেখক হিসেবে পরিচিত কমলকুমার মজুমদার। তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস অন্তর্জলী যাত্রা। এর ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন এই গ্রন্থের ভাব বিগ্রহ রামকৃষ্ণের…। আমার এই লেখাটির ক্ষেত্রেও বলতে হয় যে, এই লেখার ভাব বিগ্রহ পল গ্রাহামের, ভাষা কেবল আমার।
একটি সফল স্টার্টআপের জন্য তিনটা জিনিস দরকারী বলে মনে করেন অল গ্রাহাম। জিনিস তিনটি হলোঃ
১) ভালো মানুষদের নিয়ে শুরু করা।
২) এমন জিনিস তৈরী করা যা ভোক্তারা (কাস্টমার) চায়।
৩) যত কম পারা যায় ততো টাকা খরচ করা।
এই তিনটি জিনিস কঠিন, খুবই কঠিন; কিন্তু অসম্ভব নয়। এগুলি করা সম্ভব।
স্টার্টআপের ক্ষেত্রে কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে আইডিয়ার কথা। একটি ভালো আইডিয়া দরকার। সাধারণত মানুষেরা মনে করেন যে এমন একটি আইডিয়া দরকার যা একেবারে ব্রিলিয়ান্ট বা অনন্যসাধারণ। কিন্তু সত্যিকার অর্থে একটি সফল স্টার্টআপের জন্য আপনার আইডিয়া একেবারে ব্রিলিয়ান্ট হতে হবে এমন কোন কথাই নেই।
যে প্রযুক্তি বর্তমানে মানুষ ব্যবহার করছেন তার চাইতে ভালো প্রযুক্তিগত সেবা আপনাকে দিতে হবে। এটাই হলো আইডিয়ার মূল কথা।
যেমন, গুগলের পরিকল্পনা কেমন ছিল? এমন একটি সার্চ এঞ্জিন বানানো যাতে তখনকার সময়ে থাকা সার্চ এঞ্জিন থেকে ভালো সেবা দেয়া যায়। এজন্য তারা তিনটি নতুন আইডিয়া নিয়ে কাজ করলোঃ বেশী বেশী পেইজ ইনডেক্স করা, সার্চ রেজাল্টে কোন ওয়েবপেইজ আগে দেখাবে তা নির্ধারণ করার জন্য লিংককে গুরুত্ব দেয়া, একেবারে সহজ সার্চ পেইজ রাখা ও কিওয়ার্ডের সাথে মিল রেখে বিজ্ঞাপন দেখানো। তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল এমন একটি সাইট বানাতে যা ব্যবহার একেবারে সহজ।
এই নতুন আইডিয়াগুলিই গুগলকে আলাদা করে দেয়।
আইডিয়ার ক্ষেত্রে কথাটা হলোঃ দেখুন লোকেরা কী করতে চেষ্টা করছে
এবং ভেবে বের করুন কীভাবে আরো অসাধারণ ভাবে আপনি তা করতে পারেন।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দেখুন যে বাংলাদেশের ই-কমার্স সাইটগুলি কী করছে ও কী করার চেষ্টা করছে, দেখুন তারা কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছে, এবং ভাবতে বসে যান কীভাবে আপনি আরো অসাধারণ ভাবে, সহজভাবে ঐ কাজটিই করতে পারেন।
আইডিয়া বাস্তবায়ন করতে গেলে প্রায় সময়ই আইডিয়ার পথ পরিবর্তন হয়। যেমন, মাইক্রোসফটের প্রথম আইডিয়া ছিল প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ বিক্রি করা, কিন্তু তাদের বর্তমান বিজনেস মডেল অনেক ভিন্ন সেই আইডিয়া থেকে।
পল গ্রাহাম একটি মনে রাখার মতো কথা বলেনঃ
আইডিয়া নয়, যেসব লোকের কাছে আইডিয়াটি আছে তারাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন। ভালো মানুষেরা খারাপ আইডিয়াকে ফিক্স করে এগিয়ে যেতে পারে, কিন্তু একটি চমৎকার আইডিয়াও খারাপ লোকদের বাঁচাতে পারে না।
ভালো মানুষ কী ও কতোজন দরকার ?
এখানে ভালো মানুষ অর্থে ঐরকম মানুষ যারা তাদের কাজের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কার্যসিদ্ধি না হওয়া পর্যন্ত তারা খান্ত হয় না, কাজ করে যায়। স্টার্টআপের জন্য দরকার এরকম মানুষ। এরকম ফাউন্ডার এবং যাদের নিয়োগ দেয়া হবে তাদেরও এই চরিত্রের হওয়া চাই।
দ্বিতীয় ব্যাপার হলো, স্টার্টআপ যেহেতু ইন্টারনেট প্রযুক্তিভিত্তিক তাই ভালো প্রোগ্রামার দরকার ফাউন্ডারদের মধ্যে। ডট কম বাবলের সময় অনেক ব্যবসার লোকজন ইন্টারনেট কোম্পানি খুলেছিলেন, তারা প্রোগ্রামার হায়ার করতেন। কিন্তু সেগুলি ভালো ফল আনে নি।
একজন ভালো প্রোগ্রামার যাচাই করা সহজ নয়। অনেক সময় প্রোগ্রামাররাও তা করতে পারেন না। তাই যাদের এই ফিল্ডের সাথে পরিচয় নেই তাদের ক্ষেত্রে ভালো প্রোগ্রামার হায়ার করা হবে আরো কঠিন।
সাধারণত স্টার্টআপের ক্ষেত্রে ফাউন্ডাররা হন পরিচিত ও বন্ধুদের মধ্যে। ইউনিভার্সিটি একসাথে প্রজেক্টে কাজ করতে করতে তাদের মধ্যে পরস্পরের সক্ষমতা সম্পর্কে ধারনা জন্মে, বোঝাপড়া ভালো হয়। এভাবেই তারা একটি স্টার্টআপে জড়িয়ে পড়েন। পল গ্রাহাম সাবধান করে দেন ফাউন্ডারদের সংখ্যা যেন খুব বেশী না হয়। যত কম হয় ততো ভালো। এমন যেন না হয় যে ছবি তুললে তার গ্রুপ ফটোর মত দেখা যায়।
ফাউন্ডারদের সংখ্যা বেশী হলে সিদ্ধান্ত নিতে ঝামেলা হতে পারে বা কোন সমস্যা সমাধানে বেশী সময় লাগবে। সিদ্ধান্ত নিতে যদি ভোটাভোটির দরকার পড়ে এমন অবস্থা হয়, তাহলে প্রক্রিয়াটি হয়ে পড়বে দীর্ঘ।
কাস্টমার কী চায় ?
কাস্টমার কী চায় তা জানা কেবল স্টার্টআপের জন্যই নয়, সব ধরণের ব্যবসার জন্যই প্রযোজ্য। যেসব ব্যবসা ব্যর্থ হয় তারা সবাই কাস্টমার যা চায় তা দিতে পারে না।
রেস্টুরেন্ট ব্যবসার কথা ধরা যাক। যেসব রেস্টুরেন্ট প্রতি বছর শুরু করে ব্যবসা, এদের এক বড় অংশ ছয়মাসের ভেতরেই বন্ধ হয়ে যায়। আর আরো অনেক রেস্টুরেন্ট যারা ভালো খাবার দিতে পারে, তারা টিকে থাকে। স্টার্টআপের জন্যও একই কথা।
কিন্তু কীভাবে একজন জানবেন যে কাস্টমার কী চায়?
এর জন্য প্রথমে প্রোটোটাইপ তৈরী করে যেতে হবে কাস্টমারদের কাছে। তারা সেটি ব্যবহার করে দেখবেন। এই পন্থায় কাজ করা চমৎকার। কারণ প্রাথমিক প্ল্যানে অবশ্যই ভুল থাকবে। কাস্টমাররা সে ভুল ধরিয়ে দেবেন।
ডট কম বাবলের সময় অনেক কোম্পানি প্রথমে ইঞ্জিনিয়ার হায়ার করে, পরিকল্পনা করে সফটওয়ার তৈরী করে। পরে দেখা যায় তারা যে পণ্য তৈরী করেছে তা লোকেরা ব্যবহার করছেন না। কিন্তু তৈরীতে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ হয়ে গেছে। এই পন্থায় কাজ ঠিক নয়।
টাকা খরচ না করা !
যখন আপনি ইনভেস্টরের কাছ থেকে বা অন্যভাবে প্রচুর টাকা পেলেন আপনার স্টার্টআপের জন্য তখন কী করবেন? স্বাভাবিক ভাবেই খরচের হিসাব করতে কিংবা খরচ করতে শুরু করবেন কিন্তু স্টার্টআপ সফল করার সূত্র বলছে টাকা খরচ করবেন না।
গুগল নিজের ব্র্যান্ড বিজ্ঞাপনের জন্য কোন খরচ করে নি। কারণ তারা জানতো যে এখানে সেবা বিষয়। আরো কোন ভালো সার্চ ইঞ্জিন এলে তাদেরটা কেউ ব্যবহার করবে না। স্টার্টআপে আপনি ডিটারজেন্ট, ভদকা বা সিগারেটের ব্যবসা করছেন না যে ব্র্যান্ডিং এ টাকা ঢালবেন।
এসব নিয়ে সিরিয়াসলি ভেবে দেখুন। আপনার ব্যবসা কি ব্র্যান্ড নির্ভর? না সেবা নির্ভর?
খুবই হিসাব করে এবং একেবারে প্রয়োজনমত টাকা খরচ করতে হবে। অফিসের জন্য অনেকে বিলাসী জায়গা বেছে নেন। একে সুন্দর করতে টাকা ঢালেন। কিন্তু এরও কোন দরকার নেই।
আপনার অফিসের চেহারা প্রফেশনাল করার চেষ্টার চাইতে কাজটাকে প্রফেশনাল করুন। কাজটা হচ্ছে আপনার নির্মিত সফটওয়্যার। কর্পোরেট অফিস না নিয়ে বাসা ভাড়া নিয়ে শুরু করুন।
পল গ্রাহামের মতে স্টার্টআপ বাইরে থেকে দেখতে যত কঠিন মনে হয় আসলে তত কঠিন নয়। এমন কিছু তৈরী করুন যা ব্যবহারকারীরা ভালোবাসে ব্যবহার করতে, এবং যা আয় করবেন তার চাইতে কম ব্যয় করুন।
- Written by: bdpreneur
- Posted on: June 1, 2018
- Tags: উদ্যোগ, নতুন ব্যবসা, ব্যবসা ব্যবস্থাপনা, লিন স্টার্টআপ, স্টার্টআপ